আজ ০৪ ডিসেম্বর। লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন ভোরে লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল গুলিবর্ষণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ওই ঘাঁটির দুই শতাধিক রাজাকার ও হানাদার। এটাই ছিল লক্ষ্মীপুরে হানাদারবিরোধী মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ প্রতিরোধ।
নয় মাসে লক্ষ্মীপুরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ৩৭টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। এতে শহীদ হন ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বীর শহীদরা হলেন- মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্লাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো. মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এস এম কামাল, মিরাজ উল্ল্যা, মো. আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেনু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল রশিদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো সময় জুড়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও এ দেশীয় রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষত বিক্ষত ছিল।
অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য গেরিলা যুদ্ধ তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ ছিল। ০৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে লক্ষ্মীপুর হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয়।
লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রিজ, রায়পুর আলিয়া মাদরাসা, রায়পুর এল এম পাইলট, বাগবাড়ি গণকবর, দালাল বাজার গার্লস হাইস্কুল, মডেল হাইস্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, এল এম হাইস্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদ্রাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমলনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো ছিল হানাদার ও রাজাকার ক্যাপ এবং গণহত্যার স্থান।
এদিকে, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দিঘীর পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাইস্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে জমিদার হাট সংলগ্ন উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও এল এল হাইস্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ সময় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শীহদ হন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর হাতে শত শত হানাদার ও রাজাকার নিহত হয়। জেলায় মোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১৪।
লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১লা ডিসেম্বর মিলেশিয়াদের বাগবাড়ী ক্যাম্প অনেক দূর থেকে ঘেরাও শুরু করে। প্রবল গুলিবর্ষণ করতে করতে ওই ঘাঁটির রাজাকার ও হানাদারদের অবরুদ্ধ করে ০৩ ডিসেম্বর খুব কাছে থেকে ঘাঁটি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যায় তারা। ০৪ ডিসেম্বর ভোরে হানাদাররা আত্মসমর্পণ শেষে লক্ষ্মীপুর ছেড়ে চলে যায়।
বিভিন্ন ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের নয় মাস লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ বিশাল সারের গুদামটি ছিল মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী স্থানীয় বাঙালিদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। শেষে রহমতখালী খালের ওপর মাদাম ব্রিজে ফায়ার করে হত্যা করে খালে ভাসিয়ে দেওয়া হতো লাশ। বাগবাড়ির এই জায়গাটিকে বলা হয় টর্চার সেল। যুদ্ধ শেষে এই টর্চার সেল লাগোয়া গণকবর স্থাপিত হলেও সংরক্ষণ করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বিজড়িত মাদাম ব্রিজ এলাকা। ভগ্নদশা নিয়ে পরিত্যক্ত মাদাম ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন ও স্মৃতি নিয়ে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি।