ঢাকা ০১:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লক্ষ্মীপুরে ফের বন্যা, টানা বৃষ্টিতে জলবদ্ধতায় নাকাল

oplus_1024

   লক্ষ্মীপুরে গত ৩দিনের টানা বৃষ্টিতে বন্যার পানি কমে যেয়ে ফের বৃদ্ধি পেয়েছে। সড়ক বাড়ি সব জায়গায় হাঁটু জল। জল বদ্ধতায় মানবতা জীবন যাপন করছে বাসিন্দারা। বন্যা ও জলবদ্ধতার পানিতে ৪০ হাজার ১২৫টি মাছের পুকুর-জলাশয় ডুবে যায়। পুকুর-জলাশয়ের ওপরেই ৩-৪ ফুট পানি ছিল। এতে খামারিরা চেষ্টা করলেও ঘেরের মাছ আটকে রাখতে পারেনি। স্রোতের সঙ্গে ঘেরের ছোট-বড় সব মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১৮ হাজার মৎস্যচাষি আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

খামারিরা জানান, পর্যাপ্ত জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মাছ পানির স্রোত পেলে যেভাবেই হোক চলে যায়। এতে চেষ্টা করেও মাছ আটকানো যায়নি। চোখের সামনেই সব মাছ ভেসে গেছে।

বন্যায় এটিএম হাসান মাহমুদ সোহাগ, মামুনুর রশিদ ও ইঞ্জিনিয়ার এটিএম হাসান মাহমুদ সোহাগের প্রায় ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। মাছ ভেসে গিয়ে তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি প্রতিবেদককে জানান তারা। এখন তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা দরকার বলে জানান তারা।

সদর উপজেলার আটিয়াতলি এলাকার হাসান মাহমুদ সোহাগ পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তিন বছর আগে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু এ বন্যায় তার প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। তার পাঁচ একর জমিতে মাছের প্রজেক্ট। এ ছাড়া আলাদা একটা পুকুরও আছে। পুকুরটিতে মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়।

হাসান মাহমুদ সোহাগ বলেন, বন্যায় প্রায় ৩৫ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার রুই, ২ হাজার মৃগেল ছিল। প্রত্যেকটি মাছ প্রায় এক কেজি ওজনের ছিল। আমি ছোট মাছ কখনও বিক্রি করিনি। সব সময় বড় মাছ বাজারজাত করি। রুই আর মৃগেলেই প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কাতল, পাঙাশ, তেলাপিয়া, টেংরা, শিং ও কার্পজাতীয় মাছ ছিল। টানা বৃষ্টিতে প্রথমে প্রজেক্ট ডুবে কিছু মাছ চলে যায়। পরে বন্যাতে প্রায় সব মাছ চলে গেছে। পানি দূষিত হওয়ায় যাও ছিল তা মরে গেছে। কৃষি ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা ও যুব উন্নয়নে ২ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া খাবারের দোকানে বাকি আছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ টাকা পরিশোধ নিয়েই আমি চিন্তায় আছি। ঘুরে দাঁড়ানোর মতো কোনো সুযোগ দেখছি না। হতাশার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে, কী করব তা বুঝে উঠতে পারছি না।

পশ্চিম বটতলি গ্রামের মামুনুর রশিদের প্রায় ১৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে তিনি ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেননি। পারিবারিকভাবেই তারা মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। পুঁজির সব টাকা একটি জলাশয় ও তিনটি পুকুরে বিনিয়োগ করেছেন। রুই-কাতল, মৃগেল-তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল।

মামুনুর রশিদ বলেন, চোখের সামনে সব মাছ বন্যার পানিতে ভেসে চলে গেছে। শুধু তাকিয়েই ছিলাম, কিছু করার ছিল না। দুই বছরের পুরোনো কিছু মাছ ছিল। এখন প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। পুকুরের পাশে সমতল জমিতেও প্রায় কোমর পরিমাণ পানি ছিল। চেষ্টা করেছি মাছ আটকানোর, কিন্তু পারিনি।

চাঁদখালী গ্রামের গাজী মোহাম্মাদ বেলাল ও তার ভাই যৌথভাবে ১১ একর জমিতে পুকুর কেটে মিশ্র মাছ চাষ করে আসছেন। বন্যায় তাদের প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত জাল ছিল। জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। অনেক বেশি পানি ও স্রোতের কারণে সব মাছ চলে গেছে।

গাজী মোহাম্মদ বেলাল বলেন, বন্যায় আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে শঙ্কিত। রুই, কাতল, মৃগেল ও কার্পজাতীয় প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাছ ছিল। অনুমান করছি এখন কিছু মাছ আছে। আগে খাবার দিলে যে পরিমাণ মাছ লাফালাফি করত। এখন তেমনটা দেখা যায় না।

মাছের খাবারেই প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মাছ যখন বড় হয়েছে, বিক্রির উপযোগী হয়েছে; তখনই বন্যায় সব চলে গেছে। এতে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যদি বন্যা মাছ ফেলার শুরুতে হতো। তাহলে খাবারে কম খরচ হতো, মাছও ছোট ছিল। এতে ক্ষতিও কম হতো। সরকারিভাবে একটি তালিকা নিয়েছে। কোনো সহযোগিতা পেলে আমরা উপকৃত হব।

জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, বন্যায় প্রায় ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার ১২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০ লাখ টাকার পোনা মাছের বরাদ্দ পেয়েছি। সেগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে রায়পুর,সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, চন্দ্রগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা। প্রথম দিকে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে যায় পুকুর-জলাশয় ক্ষেত-খামার, গ্রামীণ রাস্তাসহ বসতঘর। এর মধ্যে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে পানি দ্বিগুণ উচ্চতা ধারণ করে। পুনরায় ডুবে যায় পুকুর-জলাশয়, রাস্তা-ঘাট, বসতঘর ও ফসলি জমি। এখনও বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে রয়েছে। কোথাও কোথাও দুই মাস ধরেই পানিতে তলিয়ে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ।

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

লক্ষ্মীপুরের উত্তরচরবংশী ইউনিয়ন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের কমিটির বিলুপ্ত  

লক্ষ্মীপুরে ফের বন্যা, টানা বৃষ্টিতে জলবদ্ধতায় নাকাল

আপডেট : ০৫:৪৯:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪

   লক্ষ্মীপুরে গত ৩দিনের টানা বৃষ্টিতে বন্যার পানি কমে যেয়ে ফের বৃদ্ধি পেয়েছে। সড়ক বাড়ি সব জায়গায় হাঁটু জল। জল বদ্ধতায় মানবতা জীবন যাপন করছে বাসিন্দারা। বন্যা ও জলবদ্ধতার পানিতে ৪০ হাজার ১২৫টি মাছের পুকুর-জলাশয় ডুবে যায়। পুকুর-জলাশয়ের ওপরেই ৩-৪ ফুট পানি ছিল। এতে খামারিরা চেষ্টা করলেও ঘেরের মাছ আটকে রাখতে পারেনি। স্রোতের সঙ্গে ঘেরের ছোট-বড় সব মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১৮ হাজার মৎস্যচাষি আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

খামারিরা জানান, পর্যাপ্ত জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মাছ পানির স্রোত পেলে যেভাবেই হোক চলে যায়। এতে চেষ্টা করেও মাছ আটকানো যায়নি। চোখের সামনেই সব মাছ ভেসে গেছে।

বন্যায় এটিএম হাসান মাহমুদ সোহাগ, মামুনুর রশিদ ও ইঞ্জিনিয়ার এটিএম হাসান মাহমুদ সোহাগের প্রায় ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। মাছ ভেসে গিয়ে তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি প্রতিবেদককে জানান তারা। এখন তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা দরকার বলে জানান তারা।

সদর উপজেলার আটিয়াতলি এলাকার হাসান মাহমুদ সোহাগ পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তিন বছর আগে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু এ বন্যায় তার প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। তার পাঁচ একর জমিতে মাছের প্রজেক্ট। এ ছাড়া আলাদা একটা পুকুরও আছে। পুকুরটিতে মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়।

হাসান মাহমুদ সোহাগ বলেন, বন্যায় প্রায় ৩৫ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার রুই, ২ হাজার মৃগেল ছিল। প্রত্যেকটি মাছ প্রায় এক কেজি ওজনের ছিল। আমি ছোট মাছ কখনও বিক্রি করিনি। সব সময় বড় মাছ বাজারজাত করি। রুই আর মৃগেলেই প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কাতল, পাঙাশ, তেলাপিয়া, টেংরা, শিং ও কার্পজাতীয় মাছ ছিল। টানা বৃষ্টিতে প্রথমে প্রজেক্ট ডুবে কিছু মাছ চলে যায়। পরে বন্যাতে প্রায় সব মাছ চলে গেছে। পানি দূষিত হওয়ায় যাও ছিল তা মরে গেছে। কৃষি ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা ও যুব উন্নয়নে ২ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া খাবারের দোকানে বাকি আছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ টাকা পরিশোধ নিয়েই আমি চিন্তায় আছি। ঘুরে দাঁড়ানোর মতো কোনো সুযোগ দেখছি না। হতাশার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে, কী করব তা বুঝে উঠতে পারছি না।

পশ্চিম বটতলি গ্রামের মামুনুর রশিদের প্রায় ১৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে তিনি ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেননি। পারিবারিকভাবেই তারা মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। পুঁজির সব টাকা একটি জলাশয় ও তিনটি পুকুরে বিনিয়োগ করেছেন। রুই-কাতল, মৃগেল-তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল।

মামুনুর রশিদ বলেন, চোখের সামনে সব মাছ বন্যার পানিতে ভেসে চলে গেছে। শুধু তাকিয়েই ছিলাম, কিছু করার ছিল না। দুই বছরের পুরোনো কিছু মাছ ছিল। এখন প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। পুকুরের পাশে সমতল জমিতেও প্রায় কোমর পরিমাণ পানি ছিল। চেষ্টা করেছি মাছ আটকানোর, কিন্তু পারিনি।

চাঁদখালী গ্রামের গাজী মোহাম্মাদ বেলাল ও তার ভাই যৌথভাবে ১১ একর জমিতে পুকুর কেটে মিশ্র মাছ চাষ করে আসছেন। বন্যায় তাদের প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত জাল ছিল। জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। অনেক বেশি পানি ও স্রোতের কারণে সব মাছ চলে গেছে।

গাজী মোহাম্মদ বেলাল বলেন, বন্যায় আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে শঙ্কিত। রুই, কাতল, মৃগেল ও কার্পজাতীয় প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাছ ছিল। অনুমান করছি এখন কিছু মাছ আছে। আগে খাবার দিলে যে পরিমাণ মাছ লাফালাফি করত। এখন তেমনটা দেখা যায় না।

মাছের খাবারেই প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মাছ যখন বড় হয়েছে, বিক্রির উপযোগী হয়েছে; তখনই বন্যায় সব চলে গেছে। এতে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যদি বন্যা মাছ ফেলার শুরুতে হতো। তাহলে খাবারে কম খরচ হতো, মাছও ছোট ছিল। এতে ক্ষতিও কম হতো। সরকারিভাবে একটি তালিকা নিয়েছে। কোনো সহযোগিতা পেলে আমরা উপকৃত হব।

জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, বন্যায় প্রায় ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার ১২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০ লাখ টাকার পোনা মাছের বরাদ্দ পেয়েছি। সেগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে রায়পুর,সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, চন্দ্রগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা। প্রথম দিকে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে যায় পুকুর-জলাশয় ক্ষেত-খামার, গ্রামীণ রাস্তাসহ বসতঘর। এর মধ্যে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে পানি দ্বিগুণ উচ্চতা ধারণ করে। পুনরায় ডুবে যায় পুকুর-জলাশয়, রাস্তা-ঘাট, বসতঘর ও ফসলি জমি। এখনও বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে রয়েছে। কোথাও কোথাও দুই মাস ধরেই পানিতে তলিয়ে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ।