ঘূর্ণিঝড় মিধিলির তাণ্ডবে লক্ষ্মীপুরের রামগতির মেঘনার নদীর তীরে থাকা অর্ধশতাধিক মাছ ধরার ছোট নৌকা বিধ্বস্ত হয়েছে। এ সময় ডুবে গেছে বেশ কয়েকটি নৌকা।‘মিধিলি’র প্রভাবে লক্ষ্মীপুরে ঝড়ো হাওয়ায় অনেক গাছপালা উপড়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে অনেক ঘরবাড়ির। বিভিন্ন এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে।বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। ব্যাহত হয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও।
শনিবার (১৭ নভেম্বর) রামগতি ও কমলনগর এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে এমন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। দুই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভেঙে পড়ছে বিদ্যুতের খুঁটি। ক্ষেতের আধাপাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শীতকালীন সবজি পানিতে নষ্ট হয়েছে।
কবে ঝড়ে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এখনো জেলাজুড়ে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত ও হালকা বাতাস বইছে। ফলে এখানকার জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট নৌঘাট থেকে লক্ষ্মীপুর-ভোলা-বরিশাল রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টার দিকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট লঞ্চঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক সুপার ভাইজার শরীফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘাটে স্পিডবোট ও ইঞ্জিন চালিত নৌকাও বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।
তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর-ভোলা-বরিশাল রুটে ৯ টি লঞ্চ চলাচল করে। এর মধ্যে ৩টি বরিশাল ও ৬টি ভোলা রুটের। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে নদীতে প্রবল বাতাস বইছে। ভয়ে কেউই লঞ্চ ছাড়বে না। তবুও বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মজুচৌধুরীরহাট লঞ্চঘাট থেকে সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘাটে ৬টি লঞ্চ রয়েছে। বাকি দুটি লঞ্চ বরিশাল ও একটি ভোলা ঘাটে রয়েছে।
ফেরি চলাচলের বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মজুচৌধুরীরহাট ফেরীঘাটের প্রান্তিক সহকারী রেজাউল করিম রাজু।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) বিকেলে উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া ঝড়ের তাণ্ডবে ওই এলাকার অন্তত ২০টি কাঁচাঘর বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢেউয়ের তোড়ে বড়খেরী নৌ পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন বেড়িবাঁধের পাশে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের ৫০টির বেশি নৌকা বিধ্বস্ত হয় ও বেশ কিছু নৌকা ডুবেও যায়। এতে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া ও রামগতি-কমলনগর উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ উপচে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রামগতি কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলায় ফসলী ও সবজি মাঠের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া ঝড়ের প্রভাবে রায়পুর ও সদর এলাকায় অসংখ্য কাঁচাঘর ও গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে সংযোগ।
জেলার কমলনগর উপজেলার মতিরহাট এলাকায় মেঘনা নদীতে ৩টি জেলে নৌকা ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এসব নৌকার জেলেরা সাঁতরে তীরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচা-পাকা রাস্তা ঘাটের। ক্ষতি হয়েছে আমন ও শীতকালীন সবজির। কমলনগর ও রামগতি উপজেলার সংযোগ খালের বাঁধ ধসে পড়েছে।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে জেলার ৫টি উপজেলায় ঝড়ো বাতাসে ক্ষয়ক্ষতির এসব খবর জানা গেছে। স্থানীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষয়ক্ষতির খবর নিশ্চিত করেছেন।
ঝড়ো বাতাসে ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকেই খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে বলেও জানা গেছে। চরগাজী ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বয়ারচর এলাকার দিকে ২০টির বেশি টিনশেড ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।
চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তাওহিদুল ইসলাম সুমন বাংলানিউজকে বলেন, বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা নদীর তীরে ছোট ছোট নৌকা রেখে সেগুলোতে বসবাস করেন। নৌকাগুলো দিয়ে তারা মাছ শিকার করেও জীবিকা নির্বাহ করেন। ঝড়ের তাণ্ডবে বেশ কিছু নৌকা ডুবে গেছে তাদের। আবার বেশ কিছু নৌকা ভেঙে গেছে। সবমিলিয়ে অর্ধশতাধিক নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি।
তিনি বলেন, আমার এলাকায় ১৫-২০টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে পুরোপুরি সঠিক তথ্য এখনও পাইনি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে। কিছু গাছপালাও উপড়ে পড়েছে।
রামগতি নৌ-পুলিশের ইনচার্জ (পরিদর্শক) ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ঝড়ের কবলে পড়ে অর্ধশতাধিক নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নৌকাতে কোনো লোকজন ছিল না। তাই কোনো প্রাণহানির খবর পাইনি। ঝড়ের নদীর তীরে থাকা একটি মামলায় আমাদের জব্দকৃত একটি নৌকাও ডুবে গেছে।
রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মোবাইলফোনে একাধিকবার কল দিলেও নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের কারণে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
রায়পুর পৌরসভা শহরের বাসিন্দা ডাঃজেসি দেবনাথ বলেন, গত শুক্রবার (১৭ নভেম্বর)সকাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত পৌর এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। কখন আসবে তাও জানা নেই। দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুছ মিয়া বলেন, ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখনও আমার কাছে আসেনি। বিভিন্ন উপজেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে পাঠানো হবে। পরে এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানানো যাবে।
জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন ,
২৮৯টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ১৮৯টি স্থায়ী ও ১০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো। এ কেন্দ্রগুলো ১০ লাখ ৫ হাজার ২৫০ জনের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ত্রাণের জন্য ২২ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা ও ৪৭০ মেট্টিক টন চাল মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া শিশু ও গো-খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ আছে। তিনি আরো জানান, স্বপ্নযাত্রার ১৭টি অ্যাম্বুলেন্সসহ সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছিলো। এ ছাড়াও জরুরী প্রয়োজনীয় জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ে হটলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চ ও ফেরিঘাট থেকে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে। নদী উত্তপ্ত থাকা অবস্থায় যেন নৌযান চলাচল না করে তা তদারকি করা হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও ও জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থা কমিটির সভা করা হয়েছে জানিয়ে ডিসি বলেন, ‘মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনতে প্রশাসনসহ সিপিপি ও রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসতে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান জানিয়ে উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করা হয়েছিলো রামগতির চরগজারিয়া ও চর আব্দুল্লাহ নদী বেষ্টিত চরেও।