কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাজাকারপুত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিরা কমিটিতে পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তরেও অভিযোগে জমা পড়েছে।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে সভাপতি এবং কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সংসদ সদস্য মো. মুজিবুল হককে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের চার মাসের মাথায় গত ৯ এপ্রিল ৭৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এ কমিটিতে ১১ জনকে সহসভাপতি, ৩ জনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ৩ জনকে সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৭ জনকে বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে এবং সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে ৩৯ জনকে।
২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল ও মুজিবুল হক। নতুন কমিটিতে বিতর্কিতদের পদ পাওয়া ও দলের বেশকিছু ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ত্যাগী নেতাদের পক্ষে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর গত ১২ এপ্রিল লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জেলার চৌদ্দগ্রামের এক আওয়ামী লীগ নেতা।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর অভিযোগে বলা হয়, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অনেক ত্যাগী নেতা বাদ পড়েছেন। গত তিন দশকের বেশি সময় আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে নিবেদিত কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন এমন নেতাও উপেক্ষিত হয়েছেন। আবার অন্য সহযোগী সংগঠনে পদ থাকার পরেও অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদ দেওয়া হয়েছে। জেলার নাঙ্গলকোটের এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর পুত্রকে দেওয়া হয়েছে সহসভাপতির পদ। এ ছাড়া শিবির, বিএনপি, ফ্রিডম পার্টির নেতা, খুনের মামলার আসামিও রয়েছে। লিখিত অভিযোগে নামের সঙ্গে প্রত্যেক বিতর্কিত নেতার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন অভিযোগকারী।
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি পদ পাওয়া কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন কালুর পিতা আকবর আলী একজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী। ১৯৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা কলিমুল্লাহকে হত্যা মামলার আসামি তিনি। এ ছাড়া কালু বিএনপি, জাতীয় পার্টি হয়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন। কথিত ‘হাইব্রিড’ নেতা ব্যবসায়ী এ জেড এম শফিউদ্দিন পেয়েছেন সহসভাপতির পদ। এ.এম শাহাদাত হোসেন (তসলিম) যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে থেকেও কমিটিতে সহসভাপতি পদ পেয়েছেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বপন বুড়িচং উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা পলাশ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। কিন্তু শাস্তি না দিয়ে তাকে পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হলো।
আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী দত্ত কুমিল্লা মহানগরীর বাসিন্দা। প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক খালেদ আহমেদ তালুকদার চঞ্চল কুমিল্লা শহরে থাকলেও তিনি চাঁদপুরের বাসিন্দা। অথচ তাকে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগে পদায়ন করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এহতেশামুল হাসান ভূঁইয়া রুমি যুবলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক। আরেক ‘হাইব্রিড’ নেতা আলী আকবরকে দেওয়া হয়েছে কোষাধ্যক্ষের পদ। নোয়াখালীর রুপম মজুমদারকে করা হয়েছে সাংগঠনিক সম্পাদক। নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়র এবং উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল মালেককে করা হয়েছে সদস্য।
উপপ্রচার সম্পাদক কামরুল হাসান মুরাদ চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি সবার কাছে জামায়াত পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচিত। তার বড় ভাই অ্যাডভোকেট মহসিন ভূঁইয়া পঞ্চগড় জেলা জায়ামাতের আমির। কখনো আওয়ামী লীগের জন্য কাজ না করা এমরানুল হক কামাল ওরফে ভার্ড কামালকেও কমিটির সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে। দল না করেও সদস্য হয়েছেন মো. কামাল উদ্দিন। এ ছাড়া ছাত্র শিবিরের এক সময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাবেক নেতা এ বি এম এ বাহারকে করা হয়েছে ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। জামায়াতের হয়ে কাজ করা বাহার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান।
কমিটিতে বিতর্কিতদের স্থান দেওয়ার পাশাপাশি উপদেষ্টা পদেও রয়েছে নানা অভিযোগ। উপদেষ্টা সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের ও বাহার দুজনই সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হকের ভাতিজা। আরেক নেতা অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন ফ্রিডম পার্টির নেতা। কমিটিতে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবু জাহেরকেও পদ দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই কমিটিতে বেশ কয়েকজন বিতর্কিত মুখ এসেছে। বিষয়টি সবাই জানেন। বিতর্কিতদের পদ দিয়ে ত্যাগীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ নেতারা করেছেন চরম স্বজনপ্রীতি। এই কমিটি নিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বপন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে হত্যা মামলার কথা বলা হয়েছে সেটা থেকে আমি অব্যাহতি পেয়েছি। আর বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছি সেটা সবাই জানেন। পদবঞ্চিতরা বর্তমানে এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছেন। তবে আমি বিষয়টিতে পজেটিভলি দেখছি।’
অন্যান্য নেতাকে নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ দল। এখানে জেলা কমিটি ঘোষণা হলে বিতর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। সবকিছু যাচাই করেই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কমিটি ঘোষণা করেছেন। আর বিতর্ক থাকার নামই রাজনীতি। আমরা বিষয়টি নিয়ে মোটেও চিন্তিত নই। দলের নেতারা যেটা ভালো মনে করছেন, সেটাই হবে।