মো.ওয়াহিদুর রহমান মুরাদ :
লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে
রায়পুরে নামেই মিল্কভিটা সমবায় সমিতি, বছরের পর বছর বন্ধ দুগ্ধসংগ্রহ ও উৎপাদন। সমবায় সমিতির নামে গড়ে উঠা মিল্ক ভিটার রায়পুর দুগ্ধ কারখানা এখন বন্ধ হওয়ার পথে।
১৯৯৮ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলাধীন মিতালী বাজারে ৫.৪৭ একর জায়গার উপর গড়ে উঠে দেশের অন্যতম দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার আওতাধীন দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন রায়পুর দুগ্ধ খামার। এ উপজেলায় মিল্কভিটার দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায়ের আওতাধীন শুরুতে ৬০ টি খামার গড়ে উঠলেও বিভিন্ন কারণে অকারনে ধীরে ধীরে সবগুলোই বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৭৫ হাজার টামকা ( এরও অধিক টাকা এখান থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা দুগ্ধ খামার গুলো কেন বন্ধ হয়ে গেল তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত রায়পুর দুগ্ধ খামারের পরিচালক ।
তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানাযায়, সমবায়ী দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারীদের কাছ থেকে নিম্ন মূল্যে দুধ ক্রয়,দুধের গুনগত মান সম্পর্কে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা,আর খামারিদের গো-খাদ্যের নানাবিধ সংকটের কারণেই খামারিরা তাদের নিজ নিজ খামার গুলো বন্ধ করে দেয় আর অপরদিকে মিল্কভিটার রায়পুরের এই প্রধান খামারটি তাদের প্রদত্ত ঋণের অর্থ আদায়েও তারা ব্যার্থ হন। এসব খামারীরা প্রতিদিন নিজস্ব খামারে উৎপাদিত গরু ও মহিষের দুধ শর্ত সাপেক্ষে নির্ধারিত স্বল্প মুল্যে সরবরাহ করে আসছিল এ কারখানায়। প্রতিদিন একেকটি সমিতি ৪শ থেকে ৫শ’ কেজি দুধ সরবরাহ করতো। ওই সময়ে মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ লাভবান হলেও লাভের মুখ দেখেনি খামারীরা। তবে বিশেষ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে খামারীদের ভাগ্য উন্নয়নের আশান্বিত করে কর্তৃপক্ষ। রায়পুর কারখানা সূত্র জানায়, সমবায়ীদের কাছ থেকে দুধ কিনে রায়পুরের মিতালি বাজারের কারখানায় শীতলীকরণ (ঠান্ডা) করে মিল্ক ভিটার প্রধান কারখানা ঢাকার মিরপুরে পাঠানো হত। ৩৮টি সমিতির শতাধিক খামারি এ কারখানায় দুধ সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ে দুগ্ধখামারের দুধ সংগ্রহ বন্ধ হওয়ায় খামারিরা অন্তহীন সমস্যার মধ্যে রয়েছেন বলে জানান।
দুধ সংগ্রহ বন্ধ থাকায় একদিকে খামারিদের কাছ থেকে বকেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ এবং অন্যদিকে খামারিরা মিল্ক ভিটায় জমাকৃত শেয়ার-সঞ্চয় ফেরত চেয়ে দিয়েছেন পাল্টাপাল্টি আইনি নোটিস। দিলীপ কেন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘মিল্ক ভিটা কার্যক্রম বন্ধ করার পর ঋণের কিস্তি নগদ টাকা নেয়া শুরু করে। গত ২০১৯ সালে হঠাৎ সমবায়ী সমিতিগুলোকে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের জন্য আইনি নোটিস দেয় মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ। অথচ তাদের কাছে সমবায়ী খামারিদের শেয়ার ও সঞ্চয়ের যে পরিমাণ আমানত জমা রয়েছে, তা বকেয়া ঋণের থেকেও বেশি। তাই আমরা নিজ নিজ সমিতির পক্ষ থেকে টাকা ফেরত চেয়ে মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষের কাছে আইনি নোটিস পাঠাই।’
রায়পুর মিল্ক ভিটার এক কর্মকর্তা বলেন, ৩৮টি সমবায় সমিতি মিল্ক ভিটা থেকে ঋণ নিয়ে খামার পরিচালনা করত। মিল্ক ভিটায় দুধ দেয়ার মাধ্যমে কিস্তিতে ঋণের টাকা পরিশোধ করত তারা। দুধ সংগ্রহ বন্ধ হওয়ার পর থেকে লোকসানে পড়ে খামারিরা নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি। এতে খামারিদের কাছে ৬০ লাখ টাকা বকেয়া ঋণ পড়ে রয়েছে। এজন্য মিল্ক ভিটা আইনি নোটিস দেয়।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, সে সময় কারখানা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. ফরহাদ হোসেন। অভিযোগ রয়েছে সমবায় খামারিদের কাছ থেকে কেনা দুধের গুণগত মান নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হতো। এতে খামারিরাও মিল্ক ভিটায় দুধ দেয়া নিয়ে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। কাজিরচর ও চর কোরালিয়ার কয়েকজন খামারি জানান, মিল্ক ভিটা দুধের মূল্যবাজার থেকে কম দিলেও তারা প্রজনন বীজ, চিকিৎসাসেবা, ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে খামারিদের সহযোগিতা করত; যা চরাঞ্চলের খামারিদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই ছিল। যদিও চিকিৎসাসেবা, ওষুধসহ নানা প্রণোদনা ছাড়ে সংশ্লিষ্টদের অনিয়মের শেষ নেই। কাজির চর দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি মফিজ মিয়া বলেন, ‘মিল্ক ভিটা বড় বড় রাঘববোয়ালরা নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে অনিয়মের প্রতিবাদ করে কিছুই করতে পারব না। তাই দুধ সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়ার পর খামারিরা দিশেহারা হয়ে কম দামেই তাদের গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
আব্দুল করিম নামে একজন সমিতির সদস্য বলেন, দুধ ও মাংসের পাশাপাশি খামারিদের ভাগ্যোন্নয়নের সেই বিশেষ প্রকল্পটি রায়পুর মহিষ উন্নয়ন ও কৃক্রিম প্রজনন প্রকল্প নামে অনুমোদন পায়। সরকারি ৭৫ ভাগ ও মিল্ক ভিটা সমবায়ীদের ২৫ ভাগ অর্থায়নে ১৮ কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকার এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের থেকে উন্নত মুররাহ্ জাতের মহিষ কেনে কর্তৃপক্ষ। সেগুলো স্থানীয় ক্ষুদ্র সমবায়ী খামারিদের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ ও ষাঁড়-মহিষ থেকে সংগৃহীত বীজ (সিমেন) খামারিদের দেশীয় মহিষে সরবরাহের কথা ছিল, কিন্তু সেগুলো বণ্টন না করে মিল্ক ভিটাই লালনপালন শুরু করেছে। মহিষের সে প্রকল্প থেকে দৈনিক ২০০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। খামারিদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টরা নিজেদের লাভের জন্য এসব দুধ বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে দেয়, যার জন্য দুধ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। এতে সমবায়ী খামারিদের খেসারত দিতে হচ্ছে।
রায়পুর মিল্ক ভিটার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ডা. আশরাফুজ্জামান অবশ্য বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক। পাঁচ বছর আগে ১০০টি মহিষ আনা হয়েছিল। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৬৩টি। এছাড়া ৮০টি মহিষ বিক্রিও করা হয়েছে। এতে দেড় কোটি টাকা মিল্ক ভিটার আয় হয়েছে। রাখালের মাধ্যমে উন্নত জাতের মহিষগুলো দেখভাল করা হচ্ছে।’ দুধ সংগ্রহ বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা প্রয়োজন। তবে রায়পুর সমিতির খামারিরা মিল্ক ভিটায় দুধ দিতে চাইলে আমরা সংগ্রহ করব। কিন্তু তারা শুধুই মিথ্যাচার করছে। বেশি দাম পাওয়ায় বাজারেই তা বিক্রি করে দেয়।’
রায়পুর মিল্ক ভিটা সমবায় সমিতির বিষয়ে লক্ষ্মীপুর -২ আসনের সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণী মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য এড.নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি বলেন, সমিতি কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দুগ্ধ উৎপাদন কেন বন্ধের পথে, পরিকল্পনা কি বিষদ বিষয়ে অবহিত রয়েছি। মিল্কভিটার সমস্যা ও আধুনিকায়নের জন্য মন্ত্রী মহোদ্বয়ের সাথে আলোচনা রয়েছে। আশারাখি এটি এলাকার বেকারত্ত্ব নিরসনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।