মোঃওয়াহিদুর রহমান মুরাদ।
দেশের ৭০ ভাগ সয়াবিন উৎপন্ন হয় লক্ষ্মীপুরে
রায়পুর সহ লক্ষ্মীপুর জেলা জুড়ে। রায়পুর সহ লক্ষ্মীপুর জেলা জুড়ে সয়াবিনের বীজের জন্য রায়পুর বিখ্যাত , দামেও সন্তুষ্ট কৃষকরা ।
লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন চাষ দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগ সয়াবিন এ জেলায় উৎপাদিত হচ্ছে। সর্বপ্রথম একসাথে ১৯৮২ সালে এ জেলার রামগতি উপজেলায় মাত্র ১ হেক্টর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সয়াবিনের চাষ করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এমসিসি ও ডর্প নামক দুটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সয়াবিন চাষে কৃষকদেরকে ব্যাপক উদ্বুদ্ধ করে। তখন থেকেই ধীরে ধীরে অন্য রবি ফসলের সাথে সয়াবিনের আবাদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। উৎপাদন খরচ কম, ভালো দাম ও ফলন পাওয়ায় বর্তমানে জেলার চাষীরা অন্য রবি শস্যের পরিবর্তে দিন দিন সয়াবিন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এভাবে প্রতিবছর ক্রমন্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে বিগত রবি মৌসুমে (২০১৫-১৬) এজেলায় ৫২,৭২০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয় এবং প্রায় ১ লক্ষ মেঃ টনের বেশি সয়াবিন উৎপন্ন হয় যার বাজার মূল্য তিনশত কোটি টাকার বেশি।
অন্যদিকে মেঘনা নদীর বিশাল চরের বুকে ২০ হাজার একর জমিতে অসময়ে চাষ হয়েছে সয়াবিন। অসময়ে উৎপাদিত এ কাঁচা সয়াবিনের পুরোটাই প্রধান মৌসুমের বীজ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছে বিক্রি হচ্ছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে সয়াবিন সংগ্রহ, মাড়াইসহ ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত হাজারও কৃষক-কৃষাণী। কয়েকটি ফসলি জমি থেকে অসময়ে উৎপাদিত এ সয়াবিনের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ২শ’ কোটি টাকা। এ কৃষিতে জড়িয়ে আছে পশ্চিমাঞ্চলীয় ভূমিহীন ৫ হাজার কৃষক। কাঁচা সয়াবিন দ্বিগুণ দামে বিক্রি সত্ত্বেও বাজারে তা প্রবল চাপ তৈরি করেছে প্রচলিত শুকনো বীজ ব্যবসার ওপর।
উপকূলীয় এলাকা সমূহের নদীর মাঝে চরে গিয়ে দেখা গেছে, বাজার সংলগ্ন প্রতিটি নদীর ঘাটে মেশিনে মাড়াই করা সয়াবিন নৌকাবোঝাই করে ঘাট পার করে বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষক। পরে আড়ৎদার ও পাইকারি বীজ বিক্রেতাদের হাত বদল হয়ে তা চলে যাচ্ছে কৃষকের মাঠে।
স্থানীয় চর কাছিয়ার মোল্লারহাঁট বাজার এবং পানিরঘাট বীজ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন শুকনো বীজ যেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১শ টাকায় সেখানে কাঁচা নতুন বীজ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে২১০ টাকায়। গত প্রায় ১ মাস ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত কৃষক।
গত সপ্তাহ জুড়ে সরেজমিন দেখা গেছে, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউপির চরাঞ্চলের কৃষক জানান, রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউপির চর কাছিয়ার পানির ঘাট এবং মোল্লারহাটে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বীজ সয়াবিনের হাট বসে। গত প্রায় এক মাস যাবত প্রতি হাটে গড়ে প্রায় ৫শ’ থেকে হাজার টন সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে।
রায়পুর হাবিব এন্টারপ্রাইজ এর ম্যানেজার জামাল মিয়াজী বলেন , এ উপজেলায় আরো ৫টি বাজারে বীজের হাট বসে। জেলার অন্য সয়াবিন উৎপাদনকারী উপজেলা, নোয়াখালী এবং চাঁদপুরের কৃষকরা সয়াবিন বীজের প্রধান ক্রেতা। মেঘনা নদীর চর কাছিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর, চর ইন্দুরিয়ায় উৎপাদিত সয়াবিন এসকল বাজারে আসে।কৃষক এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক সংরক্ষিত আগের বছরের শুকনো বীজের তুলনায় নতুন কাঁচা উৎপাদিত বীজ শতভাগ গজায়। সে কারণে দ্বিগুণ বেশি দামেও কৃষক কাঁচা সয়াবিন বীজ সংগ্রহ করছে। প্রতি কেজি দুইশ’ টাকা দরে ৪শ’ কেজি সয়াবিন বিক্রি করেছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, এ বছর চরে কয়েক দফা জলোচ্ছ্বাসের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। তবুও ২ একর জমিতে তিনি ১ হাজার কেজি সয়াবিন পাওয়া গিয়েছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস হচ্ছে সয়াবিন চাষের প্রধান মৌসুম। কিন্ত এ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই মেঘনার চরের বালুময় মাটি থেকে সয়াবিন ঘরে তোলে কৃষক। কাঁচা সেই সয়াবিন সাথে সাথেই আবার মাটিতে বপন করেন কৃষক। উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী দুই
ইউনিয়নের মেঘনা নদীর চর কাছিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর, চর ইন্দুরিয়া এবং সদর উপজেলার মেঘার চরে গত ৩-৪ বছর যাবত অসময়ে (বর্ষাকালে) সয়াবিন চাষ করছে চরের কৃষকরা।
রায়পুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ তওমিনা খাতুন জানান, এ সকল উপকূলীয় এলাকায় অসময়ে প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। প্রচলিত সয়াবিনের তুলনায় বেশি দামের কারণে এর বাজার মূল্য প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা।এখন কৃষকগণ সয়াবিন নিজেরাই সংরক্ষণ করতে সক্ষম। শরৎকালে এ জেলায় ৫০০ হেঃ জমিতে প্রায় ১০০০ মেঃ টন সয়াবিন উৎপাদত হয়। যার সম্পূর্ণটাই বীজ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সয়াবিন একটি পরিবেশ বান্ধব ফসল। সয়াবিনে সারের পরিমান কম লাগে। সীম গোত্রের ফসল হওয়ায় সয়াবিনের শিকড়ে নডিউল তৈরী হয়, যা হতে হেক্টর প্রতি প্রায় ২৫০ কেজি নাইট্রোজেন (ইউরিয়া সার) সংবন্ধন হয়। এ নাইট্রোজেন সার গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং একটি অংশ মাটিতে যুক্ত হয়ে পরবর্তী ফসলে অবদান রাখে। হেক্টরে সর্বোচ্চ উৎপাদন খরচ পড়ে ২০ হাজার টাকা। ভাল ফসল ও দাম পাওয়া গেলে উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি লাভ হয়। যা অন্য কোনো ফসল আবাদ করে পাওয়া যায় না। তাছাড়া সার, কীটনাশক ও পরিচর্যায় খরচ হয় তুলনামূলক কম। সয়াবিন তৈলবীজ হলেও আমাদের দেশের উৎপাদিত সয়াবিন থেকে তৈল উৎপাদন করা হয় না। এ দেশের সয়াবিন মূলত পোলট্টি খাদ্য, মাছের খাদ্য তৈরি, সয়ানাগেট, সয়াবিস্কুট, সয়ামিট, সাবান, সয়াদুধ, শিশুখাদ্যসহ নানা রকমের ৬১ টি পুষ্টিকর খাবার ও পথ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে খাদ্য হিসেবে সয়াবিনের ব্যাপক ব্যবহারের কারণ হচ্ছে এতে শতকরা ৪০ ভাগের অধিক আমিষ এবং ২০-২২ ভাগ তেল রয়েছে। এছাড়া সয়াবিন শর্করা, চর্বি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এবং ভিটামিন এ, বি ও সি’র উন্নত উৎস হিসেবে কাজ করে। সয়াবিন শুধু কোলেস্টেরলমুক্তই নয়, বরং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। মানুষের সু-স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধে সয়াবিনজাত প্রোটিনের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে স্তন ক্যান্সার, অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে সয়াবিন। সয়াবিন পেশি গঠন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া সয়াবিন হজম বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পাইলস রোগ নিরাময় করে। মেয়েদের মাসিককালীন প্রদাহ, আকস্মিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিকতা। তবে বীজের চাহিদা ব্যাপক রয়েছে আমার উপজেলায়।
উল্লেখ্য, সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষে থাকার কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের ‘ব্র্যান্ডিং নাম’ রাখে সয়াল্যান্ড। ওয়ার্ল্ড এটলাসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বের ৩৫তম দেশ। বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনে প্রধান জেলা লক্ষ্মীপুর।