লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জুন মাসে। কাজের মেয়াদ ছিল ১৮ মাস। সে হিসেবে কাজটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও সেই কাজটি এখনও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।আগামী ৪ মাসেও কাজটি বুজিয়ে দিতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয় ও শঙ্কা জেগেছে খোদ গণপূর্ত অধিদপ্তর ও সদর হাসপাতালেই।
বার বার সময় বাড়িয়ে নিচ্ছে, সঙ্গে বাড়াচ্ছে নির্মাণ খরচও।২৫০ শয্যার এ ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের।
বর্তমানে যে ভবনটিতে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে, সেটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু কখনও কখনও ওই ভবনের ১০০ শয্যার বিপরীতে পাঁচ শতাধিক রোগীও ভর্তি থাকে।
মিতু আক্তার নামে শিশু রোগীর স্বজন বলেন, আমাদের রোগীকে যে শয্যা দেওয়া হয়েছে, একই শয্যায় আরও তিনজন শিশু ভর্তি আছে। এ তিন শিশুর সঙ্গে আমরা চারজন স্বজন আছি। শয্যাতে ভালোভাবে বসার কোনো সুযোগ নেই। কোনোভাবে আমরা বসে আছি।
হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, সকালে চিকিৎসক রোগীদের দেখে যান। পুরোটা দিন নার্সদের (সেবিকা) ওপর ভরসা করে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে নার্সও সংকট।
শিশু ওয়ার্ডটিতে শিশুদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত নার্সরা জানান, রোগীর চাপে তাদের দম মেলানোর ফুরসত নেই। রোগীদের স্বজনরাও তাদের ডাকাডাকি করছেন।সেবা দিতে দেরি হলে কোনো রোগীর স্বজন বিরক্তি প্রকাশ করেন, আবার কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করেন।
দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স পূরবী রানী বলেন, ১২ রোগীর বিপরীতে ৮০ জন রোগী ভর্তি আছে। সারাদিনে আরও রোগী ভর্তি হবে। কাকে রেখে কাকে চিকিৎসা দেব? প্রত্যেক রোগীর স্বজনরা চাচ্ছে তাদের রোগীকে আগে চিকিৎসা দিতে। কিন্তু সব রোগীকেই আমাদের সেবা দিতে হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি।
দ্বিতীয় তলার সার্জারি ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুমা আক্তার বলেন, পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে শয্যা ৩০টি। রোগী ভর্তি আছেন ১৪৫ জন। নিয়মের চেয়েও কয়েকগুণ রোগী আছে এ ওয়ার্ডে। আমরা যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বেশি রোগী, তাই হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার তুলনায় ৫ গুণ রোগী আছে।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। এর আগে এটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ছিল। তবে ২০০৭ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যাতে হাসপাতালটিকে উন্নীত করা হলেও বাড়েনি চিকিৎসক এবং জনবলের পরিমাণ। প্রায় ১৮ বছরেও জনবল অনুমোদন পায়নি। সেই ৫০ শয্যার চিকিৎসক ও জনবল দিয়েই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। নামে ১০০ শয্যার হলেও রোগী সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৫০০’র ওপরে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি ছিল ৪৩৬ জন।
জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার আনোয়ার হোসেন বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। শয্যার চেয়েও পাঁচগুণ রোগী ভর্তি আছেন। মেঝেতে বিছনা বিছিয়ে তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। ভর্তিকৃত রোগীর পাশাপাশি আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১২০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। আমাদের চিকিৎসক এবং জনবল হলো ৫০ শয্যার। তাও নির্দিষ্ট পদের থেকে কম জনবল আছে। এদেরকে দিয়েই এতো পরিমাণ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা করছি, সেবা দিতে। আড়াইশ শয্যার হাসপাতালের কাজ শুরু হলে তখন ওই পরিমাণ শয্যার বিপরীতে জনবল দেওয়া হবে।গড়ে প্রতিদিন চার শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকে। প্রতিদিনই রোগীর চাপ বাড়ছে। নতুন একটি ভবন হচ্ছে। ভবনটি বুঝে পেলেই ২৫০ শয্যার কার্যক্রম চালু হবে। তখন রোগীদের ভোগান্তি কমবে। তবে ২৫০ শয্যার জনবলও নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই আমাদের ভোগান্তি কমবে। কারণ শয্যা সংকটের চেয়েও জনবল সংকট মারাত্মকভাবে আমাদের ভোগাচ্ছে। এখন ১৪৮ জনের মধ্যে আমাদের জনবল রয়েছে ১০৫ জন। তবুও চিকিৎসক-নার্সসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে নিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
মেঝেতে, করিডোরে, র্যাম্প, বারান্দায় বা শৌচাগারের সামনের অংশেও নোংরা পরিবেশে ভর্তি থাকে রোগীরা। কিন্তু আড়াইশ শয্যার হাসপাতালটি চালু হলে ভালো পরিবেশে চিকিৎসাসেবা নিতে পারতো রোগীরা।
জানা গেছে, জেলাবাসীকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৪ই মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গণপূর্ত বিভাগ থেকে ভবন নির্মাণ কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। রুপালি জিএম অ্যান্ড সন্স কনস্যুডিয়াম নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। প্রথম পর্যায়ে কাজের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ কোটি ৩৬ লাখ ৯ হাজার ৬৪ টাকা। ২০১৮ সালের ১২ জুন কাজটি শুরু করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। শুরুতে কাজের মেয়াদ ছিল ১৮ মাস। সে হিসেবে ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম দফায় শেষ না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করে। ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে কাজের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের ৭ জুন পর্যন্ত নতুন সময়সীমা বর্ধিত করা হয়। কিন্তু এরমধ্যে আরও তিন বছর পার হয়ে যায়। সব মিলিয়ে দেড় বছর মেয়াদি কাজ গিয়ে গড়ায় ৬ বছরে। কিন্তু আদৌ শেষ করতে পারেনি। এরই মধ্যে কাজের প্রাক্কলন ব্যয়ও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ ব্যয় থেকে চার কোটি ৪৩ লাখ টাকার বেশি বাড়িয়ে মোট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৯ লাখ ৪৮ হাজার ৪৭৭ টাকা।
কিন্তু বারবার সময় বাড়িয়ে এবং টাকার পরিমাণ বাড়িয়েও কাজ শেষ করা যায়নি। তবে গণপূর্ত বিভাগ বলছে চলতি বছরের জুনের মধ্যে যে কোনোভাবে কাজটি তারা বুঝে নিতে পারবেন।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর লিটন বলেন, শয্যা সংকটে রোগীরা মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মানসম্মত সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হচ্ছেনা। নতুন ভবন চালু হলে ২৫০ শয্যার সুবিধাভোগ সম্ভব হবে রোগীদের। রোগীদের কল্যাণে যে কোনো বরাদ্দও বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু হলে রোগীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রের বিদ্যমান সংকট দূর হবে বলে আশা জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসনের।
লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন (সিএস) ডা. আহাম্মদ কবীর বলেন, নতুন ভবনটি ২০২৩ সালের জুনে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। পরে সংশ্লিষ্টরা মেয়াদ বাড়িয়েছেন। আগামী জুনের মধ্যে ভবনটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্মিতব্য ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ভবনের নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ইস্কান্দার মির্জা শামীমের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
লক্ষ্মীপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন জানান, এ প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হয়ে যাবে। ঠিকাদারের আবেদনের প্রেক্ষিতে কার্যাদেশের নির্ধারিত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই আবেদনে প্রাক্কলন ব্যয়ও বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে যে কোনো মূল্যে জুন মাসের ভেতরেই কাজ বুঝে নেওয়া হবে।