ঢাকা ০৬:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুপারির খোলে তৈরি নান্দনিক তৈজসপত্ৰ : স্বীকৃতি পেল রায়পুরের অন্যতম ক্ষুদ্র শিল্প ।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় সুপারি গাছের ঝরে যাওয়া খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে গৃহস্থালির নান্দনিক তৈজসপত্র। সুপারি গাছের খোল দিয়ে থালা, বাটি, নাস্তার ট্রে, ঘড়ি, ফটোফ্রেম, বিয়ের কার্ড, ওয়ালমেট ও জুতাসহ ১৪টি পণ্য তৈরি করছে ব্রাদার্স ইকো ক্রাফট। পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত এসব পণ্য যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইউটিউবে এসব পণ্য তৈরির ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে উদ্যোক্তা মামুনুর রশিদ গড়ে তুলেছেন কারখানাটি। কারখানায় যাওয়ার পথে দুপাশে নজর কাড়ে ভরপুর সবুজ গাছ- গাছালি। সবুজ-শ্যামল পরিবেশেই কারখানাটির অবস্থান।

খোলে তৈজসপত্র তৈরিতে আগ্রহী হন রায়পুর পৌরসভার দক্ষিণ-পশ্চিম কেরোয়ার তুলাতলি এলাকার মামুনুর রশিদ। ২০১৯ সালের শুরুতে তিনি একটি টিনশেড ঘরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসিয়ে খোল দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। দূর- দূরান্ত থেকে সৌখিন লোকজন কারখানাটি দেখতে আসেন।

১৪ ধরনের পণ্য তৈরি করা হয় এ কারখানায়। এখানে ১০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। এরই মধ্যে ২০ লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটি লক্ষ্মীপুরের প্রথম কারখানা। শুকনো খাবার পরিবেশন ও পানির ব্যবহার না করলে কয়েক বছর এসব ব্যবহার করা যায়। এগুলো তৈরিতে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য

২০১৯ সালের ৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় বহুমুখী পাট পণ্য মেলার স্টল নামের এক বায়ার রায়পুর কারখানায় আসেন। এ ব্যবহার করা হয় না। পরিদর্শনকালে সুপারির খোলে তৈরি করা উদ্যোক্তা মামুনের নান্দনিক তৈজসপত্র হাতে নিয়ে দেখেন। একই বছরের আগস্টে নিউজিল্যান্ড থেকে জেরিক

সময় গ্রামীণ পরিবেশে উৎপাদিত এসব পণ্য দেখে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ২০১৭ সালে ইউটিউবে ভিডিও দেখে সুপারির

কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ৪ জন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। তারা বাছাই করা নির্দিষ্ট আকারে সুপারির খোল কাটছেন। অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করছেন থালা ও বাটি। শ্রমিকদের চোখে-মুখে যেন ব্যস্ততার চাপ।

শ্রমিক রেজিয়া খাতুন বলেন, প্রথমে খোল বাছাই করে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর তা হাতে কেটে বিদ্যুচ্চালিত মেশিনের মাধ্যমে বাসন-কোসন বানানো হয় । আমি এখানে এসেই কাজ শিখেছি। মাস শেষে পাওয়া টাকায় আমার সংসার চলে।

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে ৭ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান আছে। এ বছর সুপারিকে ঘিরে হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। গত বছর প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা আয় করেছেন লক্ষ্মীপুরের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বংশ পরম্পরায় অপরিকল্পিতভাবে করা সুপারি বাগানে প্রচুর পাতা-খোল (স্থানীয়ভাবে বাইল বলে) হয়। এতে পাতা খোল সহজলভ্য। সাধারণত এ খোল কুড়িয়ে নিয়ে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি অনেকটাই ফেলনা ছিল। অনেক মালিক না কুড়ানোর কারণে বাগানেই তা পড়ে নষ্ট হতো।

সুপারির খোল দিয়ে নান্দনিক গৃহস্থালির পণ্য তৈরি হয়, তা সম্প্রতি জানাজানি হচ্ছে। এতে স্থানীয়ভাবে সুপারির খোলের কদর বাড়ছে। অতীতে অনেক মালিক বাগান থেকে না তুললেও এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করার উদ্দেশে পাতা-খোল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জেলার যেখানেই খোলের সন্ধান পান ছুটে যান মামুন। ঝরে পরা পাতা-খোল এখন কেনাবেচা হয়। এদিকে এবার ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত এসব পণ্য। সম্প্রতি সুপারির পাতা খোল থেকে নান্দনিক তৈজসপত্র তৈরি করা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ব্রাদার্স ইকো ক্রাফটকে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) লক্ষ্মীপুর জেলা শাখা কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটিকে ঐ নিবন্ধন দেওয়া হয়।

বিসিক লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক মাকসুদুর রহমান সই করা এক পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি জানা যায়।

মেসার্স ব্রাদার্স ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী ৫৫ বছর বয়সী মামুনুর রশিদ বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানটিকে নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করি। ফরম পূরণ করে সাবমিট করতেই খোলে তৈরি করা তৈজসপত্রকে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ আমার প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরে জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক আমাকে নিবন্ধনের সনদ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুপারি গাছের খোলে তৈরি তৈজসপত্রগুলো পরিবেশবান্ধব। নান্দনিক এসব পণ্যের দেশ-বিদেশে প্রচুর চাহিদা। যত্ন নিয়ে ব্যবহার করলে এগুলো কয়েক বছর পর্যন্ত টেকে। প্ল্যাস্টিকের বিকল্প হিসেবে আমাদের পণ্যগুলো ব্যবহার করা যায়। অনলাইন মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী পরিচিতদের কাছে বিক্রি করছি। বড় পরিসরে কারখানা স্থাপন ও নতুন পণ্য তৈরির পরিকল্পনা আছে।

রায়পুর পৌরসভার মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাট বলেন, একসময় সুপারির খোল বেড়া বা জ্বালানি কাজে ব্যবহার ছিল। এখন খোল থেকে বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবেও স্বীকৃতি পয়েছে। আমরা আশা করি উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে এর প্রসার ঘটনো সম্ভব। এতে এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। রায়পুর পৌরসভার কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে অবশ্যই এগিয়ে আসবে।

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

লক্ষ্মীপুরের উত্তরচরবংশী ইউনিয়ন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের কমিটির বিলুপ্ত  

সুপারির খোলে তৈরি নান্দনিক তৈজসপত্ৰ : স্বীকৃতি পেল রায়পুরের অন্যতম ক্ষুদ্র শিল্প ।

আপডেট : ০৪:৩৩:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ এপ্রিল ২০২৩

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় সুপারি গাছের ঝরে যাওয়া খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে গৃহস্থালির নান্দনিক তৈজসপত্র। সুপারি গাছের খোল দিয়ে থালা, বাটি, নাস্তার ট্রে, ঘড়ি, ফটোফ্রেম, বিয়ের কার্ড, ওয়ালমেট ও জুতাসহ ১৪টি পণ্য তৈরি করছে ব্রাদার্স ইকো ক্রাফট। পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত এসব পণ্য যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইউটিউবে এসব পণ্য তৈরির ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে উদ্যোক্তা মামুনুর রশিদ গড়ে তুলেছেন কারখানাটি। কারখানায় যাওয়ার পথে দুপাশে নজর কাড়ে ভরপুর সবুজ গাছ- গাছালি। সবুজ-শ্যামল পরিবেশেই কারখানাটির অবস্থান।

খোলে তৈজসপত্র তৈরিতে আগ্রহী হন রায়পুর পৌরসভার দক্ষিণ-পশ্চিম কেরোয়ার তুলাতলি এলাকার মামুনুর রশিদ। ২০১৯ সালের শুরুতে তিনি একটি টিনশেড ঘরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসিয়ে খোল দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। দূর- দূরান্ত থেকে সৌখিন লোকজন কারখানাটি দেখতে আসেন।

১৪ ধরনের পণ্য তৈরি করা হয় এ কারখানায়। এখানে ১০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। এরই মধ্যে ২০ লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটি লক্ষ্মীপুরের প্রথম কারখানা। শুকনো খাবার পরিবেশন ও পানির ব্যবহার না করলে কয়েক বছর এসব ব্যবহার করা যায়। এগুলো তৈরিতে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য

২০১৯ সালের ৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় বহুমুখী পাট পণ্য মেলার স্টল নামের এক বায়ার রায়পুর কারখানায় আসেন। এ ব্যবহার করা হয় না। পরিদর্শনকালে সুপারির খোলে তৈরি করা উদ্যোক্তা মামুনের নান্দনিক তৈজসপত্র হাতে নিয়ে দেখেন। একই বছরের আগস্টে নিউজিল্যান্ড থেকে জেরিক

সময় গ্রামীণ পরিবেশে উৎপাদিত এসব পণ্য দেখে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ২০১৭ সালে ইউটিউবে ভিডিও দেখে সুপারির

কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ৪ জন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। তারা বাছাই করা নির্দিষ্ট আকারে সুপারির খোল কাটছেন। অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করছেন থালা ও বাটি। শ্রমিকদের চোখে-মুখে যেন ব্যস্ততার চাপ।

শ্রমিক রেজিয়া খাতুন বলেন, প্রথমে খোল বাছাই করে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর তা হাতে কেটে বিদ্যুচ্চালিত মেশিনের মাধ্যমে বাসন-কোসন বানানো হয় । আমি এখানে এসেই কাজ শিখেছি। মাস শেষে পাওয়া টাকায় আমার সংসার চলে।

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে ৭ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান আছে। এ বছর সুপারিকে ঘিরে হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। গত বছর প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা আয় করেছেন লক্ষ্মীপুরের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বংশ পরম্পরায় অপরিকল্পিতভাবে করা সুপারি বাগানে প্রচুর পাতা-খোল (স্থানীয়ভাবে বাইল বলে) হয়। এতে পাতা খোল সহজলভ্য। সাধারণত এ খোল কুড়িয়ে নিয়ে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি অনেকটাই ফেলনা ছিল। অনেক মালিক না কুড়ানোর কারণে বাগানেই তা পড়ে নষ্ট হতো।

সুপারির খোল দিয়ে নান্দনিক গৃহস্থালির পণ্য তৈরি হয়, তা সম্প্রতি জানাজানি হচ্ছে। এতে স্থানীয়ভাবে সুপারির খোলের কদর বাড়ছে। অতীতে অনেক মালিক বাগান থেকে না তুললেও এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করার উদ্দেশে পাতা-খোল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জেলার যেখানেই খোলের সন্ধান পান ছুটে যান মামুন। ঝরে পরা পাতা-খোল এখন কেনাবেচা হয়। এদিকে এবার ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত এসব পণ্য। সম্প্রতি সুপারির পাতা খোল থেকে নান্দনিক তৈজসপত্র তৈরি করা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ব্রাদার্স ইকো ক্রাফটকে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) লক্ষ্মীপুর জেলা শাখা কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটিকে ঐ নিবন্ধন দেওয়া হয়।

বিসিক লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক মাকসুদুর রহমান সই করা এক পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি জানা যায়।

মেসার্স ব্রাদার্স ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী ৫৫ বছর বয়সী মামুনুর রশিদ বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানটিকে নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করি। ফরম পূরণ করে সাবমিট করতেই খোলে তৈরি করা তৈজসপত্রকে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ আমার প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরে জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক আমাকে নিবন্ধনের সনদ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুপারি গাছের খোলে তৈরি তৈজসপত্রগুলো পরিবেশবান্ধব। নান্দনিক এসব পণ্যের দেশ-বিদেশে প্রচুর চাহিদা। যত্ন নিয়ে ব্যবহার করলে এগুলো কয়েক বছর পর্যন্ত টেকে। প্ল্যাস্টিকের বিকল্প হিসেবে আমাদের পণ্যগুলো ব্যবহার করা যায়। অনলাইন মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী পরিচিতদের কাছে বিক্রি করছি। বড় পরিসরে কারখানা স্থাপন ও নতুন পণ্য তৈরির পরিকল্পনা আছে।

রায়পুর পৌরসভার মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাট বলেন, একসময় সুপারির খোল বেড়া বা জ্বালানি কাজে ব্যবহার ছিল। এখন খোল থেকে বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবেও স্বীকৃতি পয়েছে। আমরা আশা করি উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে এর প্রসার ঘটনো সম্ভব। এতে এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। রায়পুর পৌরসভার কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে অবশ্যই এগিয়ে আসবে।