মাহমুদুর রহমান মনজু,লক্ষ্মীপুর:
লক্ষ্মীপুরে হঠাৎ করেই বেড়েছে ভাইরাসজনিত ‘মাম্পস’ রোগ। একই সঙ্গে বেড়েছে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে শিশু। শয্যা সংকুলান না হওয়ায় চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তবে হাসপাতালটির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মামস্ ছোঁয়াছে রোগ হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এদিকে হাসপাতালটিতে আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগেও বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। জনবল সংকট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে হাসপাতালটিতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা।
মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ্মীপুরে হঠাৎ করে বেড়েছে ভাইরাসজনিত ‘মাম্পস’ রোগ। একই সঙ্গে বেড়েছে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও। জেলার প্রায় ১৮ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ১০০ শয্যাবিশিষ্ট লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে শিশু শয্যা রয়েছে মাত্র ১৫টি। অথচ প্রতিদিনই শিশু ওয়ার্ডে গড়ে ভর্তি থাকে ৮০ থেকে ১০০ জন। এতে করে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও কর্তব্যরত সেবিকাদের।
হাসপাতাল সূত্র জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে কনসালটেন্ট ও জুনিয়র কনসালটেন্টসহ মেডিকেল অফিসারের ২২ পদের বিপরীতে রয়েছে ১৩ জন। গাইনি, নাক, কান, গলা, চক্ষু, প্যাথলজিসহ গুরত্বপূর্ণ ৭টি কনসালটেন্ট পদ খালি দীর্ঘদিন থেকে। একইভাবে নার্স, আয়া, ব্রাদার, সুইপার, ঝাড়–দার ও দারোয়ানসহ বিভিন্ন পদের সংখ্যা ১০৩টি। কিন্তু সেখানেও অর্ধেক লোক দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম।
সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতালটিতে শয্যা সংকট থাকায় একই বেডে ২ থেকে ৩ জন করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। এরপরও সংকুলন না হওয়ায় মেঝেতেও বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হয় অনেককে। তবে তাদের অভিযোগ, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণে কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। টাকা না দিলে, মিলে না সেবা, এমন অভিযোগও করেন কেউ কেউ।
হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা শাহনাজ আক্তার অভিযোগ করে জানান, হাসপাতালের পরিবেশ খুবই নোংরা, বাজে দুর্গন্ধের কারণে ওয়াশ রুমে পর্যন্ত যাওয়া যায় না। এতে রোগীর পাশাপাশি বাচ্ছার মায়েরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. জহিরুল ইসলাম রনি জানান, রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও জনবল সংকট থাকার কারণে বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তবে তারা সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
সদর হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) চিকিৎসক ডা. মোরশেদ আলম হিরু জানান, গত ২০ দিনে ভাইরাসজনিত মামস রোগে আক্রান্ত হয়ে সদর হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে সহস্রাধিক শিশু। মৌসুম পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসজনিত মামস রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বেড়েছে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও। তবে মামস রোগ ছোঁয়াছে হলেও এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে হোম আইসোলেশনে থাকলে সেরে যায় এ রোগ।
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. আনোয়ার হোসেন জানান, চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকায় কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা প্রদানে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদের। ১০০ শয্যার এ হাসপালে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকেন আড়াইশ থেকে তিনশ রোগী। বহির্বিভাগেও প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার থেকে ১১শ রোগী চিকিৎসা সেবা নিতেন আসেন। এরপরও তারা সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
মামস বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডাঃআহমেদ কবির বিস্তারিত তুলে ধরেন। মাম্পস সাধারণত শিশুদেরই হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে বয়স্করাও এ রোগে আক্রান্ত হয়। এটি ভাইরাসজনিত একটি রোগ, যা বেশ পীড়াদায়ক।
মাম্পস কী-
উভয় কানের নিচে, চোয়ালের পেছনে দুটি নালিহীন গ্রন্থির নাম প্যারোটিড গ্রন্থি। ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত এই প্যারোটিড গ্রন্থির প্রদাহকে বলা হয় ‘মাম্পস’। গ্রামে-গঞ্জে শিশুর এই রোগকে বলা হয় গাল ফোলা রোগ।
মাম্পসের লক্ষণ:-
প্রথমে জ্বর, মাথাব্যথা, গলার ব্যথা এবং কানের নিচে ব্যথা নিয়ে রোগটির শুরু। পরে একদিকের প্যারোটিড গ্রন্থি ফুলে ওঠে ও ব্যথা হয়। পরে অপর গ্রন্থি ও বেদনাযুক্ত হয়ে ফুলে ওঠে। গ্রন্থির নিঃসরণ মুখের যেখানে এসে লালার সঙ্গে মেলে, সে স্থানও লাল হয়ে ফুলে যায়। পুঁজ হয় না। এ সময় রোগীকে বেশি দুর্বল মনে হয়, রোগী অস্বস্তি অনুভব করে, ভালো করে মুখ খুলতে পারে না। মুখে দুর্গন্ধ হয়, চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ঢোক গিলতে ও খেতে ভীষণ কষ্ট হয়। এমনকি ঘাড়, কান, গলাও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর কয়েক দিন থাকে।
করণীয়:-
এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তাই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। জ্বর ও ব্যথার জন্য ওষুধ দিতে হবে এবং ইনফেকশন হলে সে জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া প্রয়োজন।
*জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ বয়স মুখে অথবা এপএ সাপোজিটরি বয়স অনুসারে দেওয়া যেতে পারে। পাঁচ বছরের নিচের শিশুকে ১২৫ মিলিগ্রাম এবং পাঁচ বছরের বড় হলে ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রার দেওয়া যেতে পারে। সাপোজিটরি খুব বেশি জ্বর ও ব্যথা না হলে দিতে নিই।রোগীকে আলাদা ঘরে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহ রাখা উচিত।রোগীর ব্যবহৃত কাপড়, জিনিসপত্র গরম পানিতে সেদ্ধ করে ধোয়া প্রয়োজন।রোগীকে প্রচুর তরল খাবার দিতে হবে।
কী করবেন না:-
আক্রান্ত অবস্থায় রোগীর প্রচণ্ড জ্বর ও ঘাড় শক্ত হয়ে গেলে, নারীদের ক্ষেত্রে তলপেটে ব্যথা করলে ও পুরুষদের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষে ব্যথা অনুভব করলে, আর ঘরে বসে থাকবেন না। কারণ, এগুলো মাম্পস এর জটিলতা নির্দেশ করে। এসব জটিলতার ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নিতে হবে।এ রোগে ছোঁয়াচে বলে এ সময় শিশুকে খুব কাছ থেকে আদর করা বা চুমু দেওয়া ঠিক নয়। এতে রোগ ছড়াবে।রোগীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে ভুলবেন না।কোনোরকম ঝাড়ফুঁক করাবেন না।