১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাদের বিরুদ্ধে পলাশীর প্রান্তরে সম্মুখ সমরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের পর প্রানভয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে এসে বর্তমান রায়পুর থানার দক্ষিন কেরোয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন একজন নবাব কাসেদ(রাজদূত)। বংশ পরম্পরায় এই সম্ভ্রান্ত কাসেদ পরিবারই জন্ম নেন ক্ষনজন্মা মানুষ মাওলানা ছায়ফুল আলম।
আরবি শিক্ষার মধ্য দিয়ে যার ছাত্রজীবনের সূচনা। রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসায়,ভারতের মধ্য প্রদেশের জৈনপুর কেরামতিয়া মাদ্রাসা,লক্নৌর নেজামিয়া মাদ্রাসা থেকে তফসির,ফিকহা,হাদিস শাস্ত্রে কামেল (টাইটেল) ডিগ্রী লাভ করেন।
ছাত্রজীবনেই তিনি ভারতীয় কংগ্রেস রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টাকালীন সময়ে স্বাধীনতাকামীদের সংগঠন খাকছার নেতা আল্লামা এনায়েত উল্লাহ খান মাশরেকির সান্নিধ্য লাভে খাকছার আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি খাকছারের সদস্য হন এবং সংগঠনের নির্দেশিত কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
তার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারনে খাকছার বাহিনী থেকে তাকে ইত্তেহাদি (একতাবন্দনাকারী) খেতাবে ভূষিত করেন।যার বদৌলতে মানুষ তাকে মাওলানা ছায়ফুল আলম ছাড়াও ইত্তেহাদি এবং খাকছার নামে সম্বোধন করতেন।
পরবর্তী সময়ে অখন্ড ভারতে যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় তখন তিনি এ আন্দোলনে যোগদান করেন।আর সেই সুবাদে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সহযোদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত তার পরিচয় সম্পর্ক গড়ে উঠে,১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ভাগের পর তিনি রায়পুর ফিরে আসেন।
১৯৪৯ সালে আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার পর তিনি রায়পুর থানা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন।সেই সময়ে পাকিস্তান মুসলীম লীগ নামক দলটি রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য আওয়ামীলীগ কে হিন্দুর দল হিসেবে অপপ্রচার করতো বিরোধীরা। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তিনি নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে আওয়ামীলীগের সভা সমাবেশে বক্তব্য করতেন আরবি শিক্ষিত মাওলানা হিসেবে।এই চির সংগ্রামী মানুষটি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের ও অন্যতম সংগঠক।
যুদ্ধ শুরু হলে বর্তমান সাগরদী গ্রামের শ্রমিক নেতা আহসান ও আওয়ামীলীগ নেতা ফজর আলী মেম্বারের বাড়িতে তিনি প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের গোপণ ট্রেনিং শুরু করেন।তারপর ভারতের রাজনগর থানার আগরতলায় একটি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের সহকারী হিসেবে আগতদের সনাক্তকরণ, তত্ত্বাবধান,ট্রেনিং প্রদান ও পাশেই একটি মসজিদে ইমামতির মত মহৎ কাজ চালিয়ে যান।উক্ত সময়ে হানাদার বাহিনী তাকে খুঁজতে এসে না পেয়ে তার প্রিয় স্বজন বড় ভাই এবং ভাবীকে হত্যা করে।দুটি অবুঝ শিশুকে পানিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করে আর প্রায় ৩৫ টি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তিনি ৩ যুগ (৩৬ বছর) রায়পুর থানা আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া লক্ষ্মীপুর মহাকুমা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি,রায়পুর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, রিলিপ কমিটির চেয়ারম্যান এবং অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা স্কুল কলেজের পরিচালনায় আজীবন নিয়োজিত ছিলেন।
উল্লেখ্য তিনি রায়পুর নতুন বাজারে একটি খাকছার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে তার নেতৃত্বে তৎকালীন জমিদার, মহাজন, জোতদার দ্বারা নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, নিপিড়িন, ভিটেমাটি ছাড়া, ভূ-সম্পত্তি নিলামে তোলার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে তা প্রতিহত করেন।
রায়পুরে শিক্ষার আলো জ্বালাবার জন্য তিনি প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।যার কারনে জমিদার পরিবারের দেয়া মামলায় তিনি দীর্ঘদিন ভোগেন। বর্তমান সরকারী কলেজটির তিনিই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ।
ওনার পরামর্শে হাসান মিয়াজী এবং মনির আহাম্মেদ মাষ্টার মিলে জুনিয়র হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন মোল্লার হাট উচ্চ বিদ্যালয় জুনিয়র স্কুল হিসেবে প্রথমে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়,যদিও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ মিয়াজী। সন 1905-1908/10
রায়পুরের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিনিই উদ্যোক্তা এবং প্রধান সমন্বয়কারী,পশ্চিম সাগরদি প্রাথমিক বিদ্যালয় (তাম্বুর স্কুল) তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।রায়পুরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ মার্চেন্টস একাডেমী প্রতিষ্ঠায় ও তার সার্বিক সহযোগীতা রয়েছে।
দক্ষিন কেরোয়া মা-ফাতেমা মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসাটি নিজ জমির উপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।এছাড়া অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা নির্মান ও সংস্কারে তার ভূমিকা ছিল অগ্রনী।
ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার, সাম্যবাদী চিন্তা চেতনার তিনি ছিলেন এক মূর্ত প্রতীক।ধর্মীয় সম্প্রিতীর জন্য কাজ করেছেন নিরলস ভাবে।এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে লোভ লালসার উর্ধ্ধে থেকেছেন তিনি।কখন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি,সরকারী সম্পদ ভোগ করেননি,অবৈধ সম্পদ আরোহন করেন নি,পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তিনি জীবনের অন্তিম মূহূর্তটিও মানুষের কল্যানে ব্যায় করে গেছেন।